Cattle Varieties of Bangladesh

আমাদের দেশের গরুর জাত সমূহঃ

দেশি গরুর মাংসের স্বাদ বিদেশি গরুর চেয়ে ভালো। তবে অনেকে বিদেশি গরুকে দেশি গরু ভেবে কিনে প্রতারিতও হন। এজন্য ক্রেতাদের দেশি গরু চেনার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু কিভাবে চিনবেন দেশি গরু?

আমাদের দেশে পাঁচ ধরনের দেশি গরু পাওয়া যায়। যেগুলো হচ্ছে, স্থানীয় দেশি জাতের গরু, রেড চিটাগাং ক্যাটল, পাবনা ক্যাটল, নর্থ বেঙ্গল গ্রে, মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল।

পশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশি পশুর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা ছোট ও মাঝারি আকৃতির। এ ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশি পশু এক রঙের হয়। এদের পা চিকন ও শিং বড় হয়। গায়ের লোম ছোট এবং দেহ চকচকে হয়। চামড়া শক্ত থাকে। এছাড়া এর কুঁজ থাকে এবং গলার নিচে চামড়ার ভাঁজ কম থাকে।

 

ক) দেশী প্রজাতির ৫ ধরনের গরুঃ

১) স্থানীয় দেশি জাতের গরু:
দেশের সবখানে এ ধরনের গরু পাওয়া যায়। এ গরু আকারে ছোট হয়। এর কুঁজ সুগঠিত থাকে। গলার নিচের চামড়া বেশ বিকশিত থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক ষাঁড়ের গলার নিচের চামড়া ঝুলে থাকে। কান লম্বা এবং পাতার মতো ভাঁজ হয়ে থাকে। এদের শিং বাঁকানো থাকে। গায়ের রং লাল, সাদা, কালো, ধূসর বা ছাইরঙা কিংবা দুই বা ততোধিক রঙের মিশ্রণও হতে পারে। এদের উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত হতে পারে। দেহের দৈর্ঘ্য (সামনের পায়ের গোড়া থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব) সাড়ে তিন ফুটের আশপাশে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি পুরুষ গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ১৫০ থেকে ২২০ কেজি হয়ে থাকে।

স্থানীয় দেশি জাতের গরু
রেড চিটাগাং ক্যাটল (আরসিসি)

২) রেড চিটাগাং ক্যাটল (আরসিসি):
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাওয়া যায় এ ধরনের গরু। এর গায়ের রং লালচে। এর পাশাপাশি মুখ, চোখের পাতা, খুর, এমনকি লেজের প্রান্তও লালচে রঙের হয়ে থাকে। এ গরুর দেহ তুলনামূলক ছোট হয়। উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) সাড়ে তিন ফুটের মতো হয়। দেহ লম্বায় সাড়ে তিন থেকে চার ফুটের কাছাকাছি হয়ে থাকে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ২৫০ থেকে ৪০০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ১৫০ থেকে ২৩০ কেজি হয়ে থাকে।

৩) পাবনা ক্যাটল:
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এ গরু সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এই জাতের গরুর বড় অংশটির রং সাদা বা সাদা মেশানো ছাই রং। এছাড়া লাল, ধূসর বা মিশ্র বর্ণেরও হয় এসব গরু।। পুরুষ গরুতে এ রং গাঢ় ধূসর ও সাদা রঙের মাঝামাঝি যেকোনো বর্ণের হতে পারে। মুখ, চোখের পাতা, শিং ও লেজের প্রান্তদেশ কালো রঙের হয়। এদের দেহ লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো আর উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) চার ফুটের মতো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২৫০ থেকে ২৮০ কেজি হয়ে থাকে। দেশীয় আবহাওয়া সহনশীল এসব গরু পালনে খাবার কম লাগে।

সিরাজগঞ্জ ব্রিড- এই জাতের গরু মূলত পদ্মাপারের কয়েকটি জেলায় হয়ে থাকে। এই জাতের গরুর সঙ্গে পাবনা ক্যাটলের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি পাবনা ক্যাটলের চেয়ে আকারে কিছুটা বড় হয়। এর কুঁজ উঁচু ও বলিষ্ঠ হয়।

এসব জাত ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাংসের চাহিদা মাথায় রেখে শাহীওয়াল এবং ব্রাহমা জাতের গরুর সাথে সংকরায়ন করে আরো কিছু জাতের প্রজনন ঘটানো হয়েছে, যেগুলো কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতাদের মন জয় করেছে।

পাবনা ক্যাটল:
নর্থ বেঙ্গল গ্রে

৪) নর্থ বেঙ্গল গ্রে:

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় নর্থ বেঙ্গল গ্রে গরুর দেখা মেলে। এর গায়ের রং সাদা বা গাঢ় ধূসর ও সাদা রঙের মাঝামাঝি, যেকোনো রঙের হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গরুর ঘাড়ে ছাই রঙের ছোপ দেখা যায়। মুখ, চোখের পাতা ও খুর কালো রঙের হয়ে থাকে। তবে লেজের প্রান্ত সাদা রঙের হয়। গরুর শিং ছোট বা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে এবং শিং ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর উচ্চতা তিন ফুটের একটু বেশি এবং দেহের দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন ফুটের কাছাকাছি হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজি হয়ে থাকে।

৫) মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল বা মিরকাদিমের ধবল গাই:
মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল প্রধানত মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম উপজেলায় পাওয়া যায়। এ গরুকে সাধারণত ‘মীরকাদিমের গরু’ বলা হয়। মুন্সিগঞ্জ ছাড়া এর পার্শ্ববর্তী জেলাতেও এ গরুর দেখা মেলে। মীরকাদিম জাতের গরুর গায়ের রং মূলত সাদা। তবে দেহের বিভিন্ন স্থানে হালকা গোলাপি রঙের আভাও দেখা যায়। শিং, চোখের পাতা, খুর ও লেজের প্রান্তদেশ গোলাপি বা গোলাপি ও কালো রঙের মিশেল হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক একটি গরুর উচ্চতা ৩ থেকে ৫ ফুট হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৮০ কেজি হয়ে থাকে।

মীরকাদিমের গরুর মাংসে আঁশ কম থাকে, এর হাড় চিকন হয়। ফলে মাংস হয় নরম ও তেলতেলে। এটি পালন সহজ, মানে খাবারের খরচ কম। খৈল, গম, মসুর ডালের ভুসি এবং ভুট্টা গুঁড়ার মত খাবার দিয়ে পালন করা যায়।

হলষ্টিন
মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল বা মিরকাদিমের ধবল গাই

খ) বিভিন্ন বিদেশী প্রজাতি ও মিক্সিড ব্রীডঃ

১) হলষ্টিন:
– হলষ্টিন গরুর উৎপত্তি হল্যাণ্ড বা নেদারল্যান্ড। এই গরুর জাতকে পূর্বে হলস্টিন-ফ্রিজিয়ান বলা হত। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এজাতের গরুদুধাল জাত হিসেবে পালন করা হয়৷
– হলস্টিন গরুর বর্ণ ছোট বড় কালো সাদা ছাপ যুক্ত। তবে পায়ের নিগংশ(হাটুর নীচে) সাধারণত সাদা হয়৷
– এই গরুর জাত এর গরুর মাথা লম্বাটে ও সোজা হয়৷ চওড়া মাজেল ও খোলা নস্ট্রিল থাকে ৷
– অন্যান্য গরুর জাত এর গরুর ন্যায় এদরে পিঠ চূড়া থাকেনা।
– এই গরুর জাত এর গাভী শান্ত স্বভাবের তবে ষাঁড় উগ্র স্বভাবের হয়। গাভীল ওজন প্রায় ৭৫০কেজি এবং ষাড়ের ওজন প্রায় ১০০০ কেজি।
– একটি হলস্টিন গরুর জাতটি গাভীর দুধ দিনে তিনবার দোহন করে এক বিয়ানে প্রায় ১৯.৯৯৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়।

২) হরিয়ানা:
– ভারতের হারিয়ানা রাজ্যে এ গরুর জাত এর আদি বাসস্থান বলে স্থানের নামানুসারে নাম করণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই গরুর জাত পালিত হয়। এটি একটি দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত গরুর জাত।
– দেহের গঠন বলিষ্ট ও আঁটসীট। লম্বা গরু পা বিশিষ্ট এই গরুর জাতও উচ্চতায় বেশ লম্বা হয়৷
– মাথা ও মুখ লম্বা ও গরু। গলা লম্বা কপাল চ্যাপ্টা, চোখ বড় বড় ও উজ্জল। শিং ছোট ও গরু যা উপর দিকে উঠানো থাকে ।
– মাথার পোল মধ্যস্থ অস্থি বেশ উন্নত। দেহের তলনায় লেজ ছোট ও গরু।
– গাভীর ওলান সামনে পিছনে প্রশস্থ। সামনের বাট পিছনের বাট অপেক্ষা লম্বা৷
– এই গরুর জাতটি কৃষি কাজ বা ভারবহন ও দুধের জন্য বেশ উপযোগী৷
– একটি গাভী প্রতি বিয়ানে প্রায় ১৪০০ লিটার দুধ দেয়।

হরিয়ানা
জার্সি

৩) জার্সি:
– প্রায় ৫০০ বছর ধরে ইংলিশ চ্যানেলের জার্সি দ্বীপে জার্সি গরুর জাতটির প্রজনন হয়ে আসছে পরিকল্পিত প্রজননের ফলে জার্সি প্রসিদ্ধ দুধাল জাত হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
– লম্বা দেহ, খাটো পা এবং চূড়া হতে কোমর পর্যন্ত পিঠ একদম সোজা থাকে।
– বিভিন্ন রংয়ের হয়। তবে প্রধানত হালকা লালচে বাদামী রং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
– চওড়া জোড়া ডিশযুক্ত কপাল৷ শিং পাতলা ও সামনের দিকে কিছুটা বাকানো থাকে ৷
– মুখবন্ধনী বা মাজেল কালো ও চকচকে হয়৷
– জার্সি জাতের গাভী বাংলাদেশের আবহাওয়ায় পালনে উপযোগী৷
– এই গরুর জাতটির গাভীর শারিরীক গঠন ছোট হওয়ায খাদ্যের পরিমাণ কম লাগে কিন্তু দুধ উৎপাদন ঠিকই হয়৷
– গাভী ভীতু প্রকৃতির কিন্তু ষাড় কিছুটা অবাধ্য স্বভাবের। গাভী মাঝারী আকৃতির এবং ওজন প্রায় ৩৯০ কেজি হয়ে থাকে৷
– গাভীর ওলান চমৎকার। ইংল্যাণ্ডের একটি জার্সি গাতী এক বিয়ানে ২৫০০-৫০০০ লিটার দুধ দেয়।

৪) শাহিওয়াল:
– শাহিওয়াল পাকিস্তানের একটি দুধাল জাতের গরু৷ বর্তমানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বহুদেশে এই গরুর জাতটি গরুপালিত হয়৷
– ধীর ও শান্ত প্রকৃতির৷ মোটাসোটা ভারী দেহ। তুক পাতলা ও শিথিল।
– পা ছোট, ছোট ও পুরু শিং নড়ে৷ মাথা চওড়া ও পোল উঁচু। কান ঝুলানো ও কানের ভিতর কালো দাগ থাকে ।
– লেজ বেশ লঙ্কা, প্রায় মাটি ছুঁয়ে যায়। লেজের আগায় দর্শনীয় এক গোছা কালো লোম থাকে
– সাধারণত এই গরুর জাতটির গরুর দেহের রং ফ্যাকাশে লাল। তবে কখনও কখনও গাঢ় লাল বা লালের মাঝে সাদা ও কালো ছাপযুক্ত হয়৷
– গাভীর ওলান বড়, চওড়া, নরম ও মেদহীন৷ লম্বা মোটা ও সমান আকৃতির বীট। দুগ্ধ শিরা বেশ স্পষ্ট যা দূর থেকেও বোঝা যায়৷
– এই গরুর জাতটির একটি গাভী গ্রামীণ অবস্থায় পালনে ৩০০ দিন দুগ্ধ দানকালে প্রায় ২১৫০ লিটার এবচং ফার্মে পালনে প্রায়
৪-৫ হাজার লিটার দুধ দেয়৷
– ষাঁড়ের দৈহিক ওজন প্রায় ৫২২ কেজি এবং গাতীল ওজন প্রায় ৩৪০ কেজি হয়ে থাকে ৷

শাহিওয়াল

৫) সিন্ধি :
– পাকিস্তানের সিন্ধু এলাকায় এজাতের গরুর আদি বাসস্থান। বর্তমানের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে গরুর জাতটি পালিত হয়৷
– সাধারণত গাঢ় লাল ও চকলেট বর্ণের হয়ে থাকে৷ গাভী অপেক্ষা ষীড়ের রং বেশী গাঢ় হয়৷
– আকৃতি মাঝারি, সুডৌল,বলিষ্ট ও দেহ আটসীট। গাভীকে শান্তশিষ্ট ও বুদ্ধিদীপ্ত দেখায়৷
– ভৌতা শিং যা পাশে ও পিছনে বাঁকানো থাকে৷ মাথা ও মুখ মণ্ডল ছোট। চওড়া কপাল। কপালের মাঝের অংশ কিছুটা উচু।
– ষাড়ের চূড়া বেশ উচু গল কম্বল বৃহদাকার ও ভীজযুক্ত৷ নাভি চর্ম বড় ও ঝুলন্ত। ষাড়ের ওজন প্রায় ৪৫০ কেজি৷
– গাভীর ওলানের গঠন বেশ সুন্দর ও সামান্তস্যপূর্ণ। ওজন প্রায় ২৯৫ কেজি৷ প্ৰতি বিয়ানে সর্বোচ্চ ৫,৪৪৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়৷ এই গরুর জাতটির বলদ দিয়ে কৃষি কাজ করা যায়৷

সিন্ধি
সংকর

৬) সংকর গরু:
– দেশী জাতের গাভীর সাথে বিদেশী জাতের ষাঁড়ের সিমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সংকর জাতের গরুউৎপাদন করা হয়।
– আমাদের দেশে প্রধানত হলস্টিন,জার্সি, শাহিওয়াল, সিদ্ধি জাতের ষাঁড়ের সিমেন কৃত্রিম প্রজননে প্রয়োগ করে সংকর জাতের গরুউৎপাদন করা হয়।
– সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য তার জাত গুলোর সংমিশ্রণে হয়ে থাকে। তাই সংকর জাতের গরুদেশী অপেক্ষা আকারে হয় এবং বেশী দুধ দেয়৷
– একটি পূর্ণবয়স্ক জাতের গাভীর ওজন ২০০-৩০০কেজি হয়ে থাকে৷
– বিদেশী উন্নত জাতের গরুঅনেক সময় আমাদের দেশের আবহাওয়ায় পালনের উপযোগী হয় না। কিন্তু সংকর জাতের পালন আমাদের দেশের জন্য বেশী উপযোগী তাই বাংলাদেশে পালনের জন্য সংকর জাতের গরুউৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
– বাংলাদেশে গরুর জাত হিসেবে ক্রস জাতের গরু সবসময় সারা দেশেই পাওয়া যায়৷

উৎসঃ
https://www.ittefaq.com.bd
https://khamarian.com